ঢাকা ০২:২১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কাশ্মিরে প্রশাসনের নির্দেশে ১০ হাজার আপেল গাছ কর্তন

ডেস্ক রিপোর্ট
  • আপডেট সময় : ১২:৫০:৪১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬৫ বার পড়া হয়েছে

২৮ ডিসেম্বর ২০২০, আজকের মেঘনা. কম, ডেস্ক রিপোর্টঃ

কয়েক দশক ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সযত্নে যে আপেল বাগান তৈরি করেছিলেন কাশ্মিরের মানুষ। সরকারি বুলডোজারের নীচে তা আজ ধুলোয় মিশে গিয়েছে। কৃষক আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলাকালীনই জম্মু-কাশ্মির প্রশাসনের নির্দেশে উপত্যকায় ১০ হাজারের বেশি আপেল গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। খবর আনন্দবাজার পত্রিকার।

খবরে বলা হয়, কাশ্মিরের আপেল চাষিরা এমনিতেই ন্যায্য মূল্য পান না। এমনকি ভারতীয় কৃষকদের মতো ন্যায্যমূল্যের দাবি করার কোনো সুযোগও তাদের নেই। তারপরও তারা বাগানগুলো করেন খুবই যত্নসহকারে। সারা বছরই ওই বাগান থেকে রোজগারের টাকায় চলে সংসার।

গত বছর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বিলোপের পর থেকে এমনিতেই গোটা দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন কাশ্মির উপত্যকা। ভাটা পড়েছে পর্যটন শিল্পেও। তাই বংশপরম্পরায় লালিত-পালিত আপেল বাগানের পরিচর্যাতেই মন দিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ, যাতে শীতের মওসুমে কিছু রোজগার হয়। কিন্তু চোখের সামনে সেই বাগানই ধূলিসাৎ হয়ে যেতে দেখলেন তারা।

খবরে আরও বলা হয়, জম্মু-কাশ্মির প্রশাসনের নির্দেশে উপত্যকায় ১০ হাজারের বেশি আপেল গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। মধ্য কাশ্মিরের বদগাম জেলার কানিদাজান-সহ আশেপাশের এলাকাতেই মূলত আপেল গাছ নিধন শুরু হয়। গুর্জর এবং বাখরওয়াল, এই দুই মুসলিম যাযাবর গোষ্ঠীর বাস সেখানে। ১৯৯১ সালে তফসিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি পায় এই দুই গোষ্ঠী। তাদের আপেল বাগানেই নিধন যজ্ঞ চালিয়েছে বন দফতর। এলাকায় মাটির কুঁড়েঘর বানিয়ে এতদিন থাকছিলেন ওই দুই গোষ্ঠীর মানুষ। সেগুলিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ৬০ বছর বয়সী আবদুল গনি ওয়াগে জানিয়েছেন, কাউকে কিছু না জানিয়ে নভেম্বর মাসে আপেল গাছ নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। শ্রীনগর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে দেড় বিঘে জমি রয়েছে আবদুলের। তাতে আপেল চাষ করতেন তিনি।

আবদুল গনির অভিযোগ, ১০ নভেম্বরের সকালে বাড়িতেই ছিলেন তিনি। হঠাৎ খবর পান যে একদল লোক কুড়াল-করাত নিয়ে তার বাগানে হাজির হয়েছেন। তড়িঘড়ি সেখানে ছুটে যান তিনি। কিন্তু গিয়ে দেখেন, পুলিশ এবং সিআরপিএফ-এর তত্ত্বাবধানে নির্বিচারে গাছ কেটে চলেছেন বন দফতরে লোকজন।

আবদুল গনি জানান, আপেল বাগানে ৫০টি গাছ ছিল তার। তার ওপর নির্ভর করেই সংসার চলত। ৭ মেয়ে রয়েছে তার। মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে পুলিশের কাছে অনুনয় বিনয়ও করেন তিনি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বরং বছর ৫০ আগে বাবার কাছ থেকে শিখে নিজে হাতে যে গাছগুলি বসিয়েছিলেন, কুড়ালের ঘায়ে সেগুলি একের পর এক মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখেন।

উপত্যকার সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ১০ নভেম্বর বনদফতরের ৫০ জন কর্মচারীর তত্ত্বাবধানে সারা দিনে প্রায় ১০ হাজার আপেল গাছ কেটে ফেলা হয় উপত্যকায়। গ্রামের মোড়ল মহম্মদ আহসান জানা, গাছ কাটার বিরোধিতা করে স্থানীয়দের মধ্যে অনেকেই এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারি কাজে বাধা দিলে মামলা করা হবে বলে হুমকি দিয়ে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করা হয়। মহম্মদ আহসান আক্ষেপ করে বলেন, ‘আপেল গাছের ডাল অত্যন্ত সরু এবং নরম। কুড়ালের এক-দু’ঘাও সহ্য করার ক্ষমতা নেই।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আপেলচাষি সংবাদ মাধ্যমে বলেন, ‘এতদিন আপেল বাগানেই সারাদিন কেটে যেত। কিন্তু ২০ দিন হয়ে গেলো, আপেল বাগানে পা রাখিনি। গাছ কেটে ফেলার পর খাঁ খাঁ করছে বাগান। ওখানে যাওয়ার মতো মনের জোর আর নেই আমার।’

কাশ্মিরে আপেল বাগানগুলি বন দফতরের জমির ওপর তৈরি বলে দাবি সরকারের। সাত পুরুষ ধরে সেখানে আপেল চাষ করে আসছেন গুর্জর এবং বাখরওয়ালরা। শুধু এই গুর্জর এবং বাখরওয়ালরাই নন, দেশের ১০ লক্ষের বেশি তফসিলি উপজাতি এবং বনবাসীরা বন অধিকার আইন ভোগ করেন। অর্থাৎ বনাঞ্চলে বসবাসের অধিকার যেমন রয়েছে তাদের, তেমনই সেখানে বসবাসের অধিকারও রয়েছে তাদেরই। কাগজে কলমে ওই জমির উপর মালিকানাও ভোগ করেন তারা। এক সময় রাজ্য থাকলেও জম্মু-কাশ্মিরে আজও ওই আইন কার্যকর হয়নি। গত বছর উপত্যকার জন্য সংরক্ষিত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করার পর, ১৫৫টি কেন্দ্রীয় আইন আপনাআপনিই সেখানে কার্যকর হয়ে যায়। বন অধিকার আইনও সেখানে কার্যকর করা হবে বলে সেইসময় আশ্বাস দিয়েছিল জম্মু ও কাশ্মির প্রশাসন। সেই সময় উপত্যকার মুখ্যসচিব বিভিআর সুব্রহ্মণ্যমের দফতর থেকে বলা হয়, ‘২০২১-এর ১৫ জানুয়ারির মধ্যে এই সংক্রান্ত সমীক্ষা সম্পূর্ণ হলে, মার্চ মাসের মধ্যে উপত্যকায় বন অধিকার আইন কার্যকর হয়ে যাবে।’

হাজার হাজার আপেল গাছ নিধন ছাড়াও স্থানীয়দের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং উচ্ছেদ নোটিস ধরানোর পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ লুকিয়ে রয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এই মুহূর্তে উপত্যকায় গুর্জর এবং বাখরওয়াল গোষ্ঠীর প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের বাস। উপত্যকার মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ এই দুই গোষ্ঠীর মানুষ। কাশ্মিরি এবং ডোগরাদের পর তারাই সেখানকার তৃতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায়।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

ট্যাগস :

কাশ্মিরে প্রশাসনের নির্দেশে ১০ হাজার আপেল গাছ কর্তন

আপডেট সময় : ১২:৫০:৪১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০

২৮ ডিসেম্বর ২০২০, আজকের মেঘনা. কম, ডেস্ক রিপোর্টঃ

কয়েক দশক ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সযত্নে যে আপেল বাগান তৈরি করেছিলেন কাশ্মিরের মানুষ। সরকারি বুলডোজারের নীচে তা আজ ধুলোয় মিশে গিয়েছে। কৃষক আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলাকালীনই জম্মু-কাশ্মির প্রশাসনের নির্দেশে উপত্যকায় ১০ হাজারের বেশি আপেল গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। খবর আনন্দবাজার পত্রিকার।

খবরে বলা হয়, কাশ্মিরের আপেল চাষিরা এমনিতেই ন্যায্য মূল্য পান না। এমনকি ভারতীয় কৃষকদের মতো ন্যায্যমূল্যের দাবি করার কোনো সুযোগও তাদের নেই। তারপরও তারা বাগানগুলো করেন খুবই যত্নসহকারে। সারা বছরই ওই বাগান থেকে রোজগারের টাকায় চলে সংসার।

গত বছর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বিলোপের পর থেকে এমনিতেই গোটা দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন কাশ্মির উপত্যকা। ভাটা পড়েছে পর্যটন শিল্পেও। তাই বংশপরম্পরায় লালিত-পালিত আপেল বাগানের পরিচর্যাতেই মন দিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ, যাতে শীতের মওসুমে কিছু রোজগার হয়। কিন্তু চোখের সামনে সেই বাগানই ধূলিসাৎ হয়ে যেতে দেখলেন তারা।

খবরে আরও বলা হয়, জম্মু-কাশ্মির প্রশাসনের নির্দেশে উপত্যকায় ১০ হাজারের বেশি আপেল গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। মধ্য কাশ্মিরের বদগাম জেলার কানিদাজান-সহ আশেপাশের এলাকাতেই মূলত আপেল গাছ নিধন শুরু হয়। গুর্জর এবং বাখরওয়াল, এই দুই মুসলিম যাযাবর গোষ্ঠীর বাস সেখানে। ১৯৯১ সালে তফসিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি পায় এই দুই গোষ্ঠী। তাদের আপেল বাগানেই নিধন যজ্ঞ চালিয়েছে বন দফতর। এলাকায় মাটির কুঁড়েঘর বানিয়ে এতদিন থাকছিলেন ওই দুই গোষ্ঠীর মানুষ। সেগুলিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ৬০ বছর বয়সী আবদুল গনি ওয়াগে জানিয়েছেন, কাউকে কিছু না জানিয়ে নভেম্বর মাসে আপেল গাছ নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। শ্রীনগর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে দেড় বিঘে জমি রয়েছে আবদুলের। তাতে আপেল চাষ করতেন তিনি।

আবদুল গনির অভিযোগ, ১০ নভেম্বরের সকালে বাড়িতেই ছিলেন তিনি। হঠাৎ খবর পান যে একদল লোক কুড়াল-করাত নিয়ে তার বাগানে হাজির হয়েছেন। তড়িঘড়ি সেখানে ছুটে যান তিনি। কিন্তু গিয়ে দেখেন, পুলিশ এবং সিআরপিএফ-এর তত্ত্বাবধানে নির্বিচারে গাছ কেটে চলেছেন বন দফতরে লোকজন।

আবদুল গনি জানান, আপেল বাগানে ৫০টি গাছ ছিল তার। তার ওপর নির্ভর করেই সংসার চলত। ৭ মেয়ে রয়েছে তার। মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে পুলিশের কাছে অনুনয় বিনয়ও করেন তিনি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বরং বছর ৫০ আগে বাবার কাছ থেকে শিখে নিজে হাতে যে গাছগুলি বসিয়েছিলেন, কুড়ালের ঘায়ে সেগুলি একের পর এক মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখেন।

উপত্যকার সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ১০ নভেম্বর বনদফতরের ৫০ জন কর্মচারীর তত্ত্বাবধানে সারা দিনে প্রায় ১০ হাজার আপেল গাছ কেটে ফেলা হয় উপত্যকায়। গ্রামের মোড়ল মহম্মদ আহসান জানা, গাছ কাটার বিরোধিতা করে স্থানীয়দের মধ্যে অনেকেই এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারি কাজে বাধা দিলে মামলা করা হবে বলে হুমকি দিয়ে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করা হয়। মহম্মদ আহসান আক্ষেপ করে বলেন, ‘আপেল গাছের ডাল অত্যন্ত সরু এবং নরম। কুড়ালের এক-দু’ঘাও সহ্য করার ক্ষমতা নেই।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আপেলচাষি সংবাদ মাধ্যমে বলেন, ‘এতদিন আপেল বাগানেই সারাদিন কেটে যেত। কিন্তু ২০ দিন হয়ে গেলো, আপেল বাগানে পা রাখিনি। গাছ কেটে ফেলার পর খাঁ খাঁ করছে বাগান। ওখানে যাওয়ার মতো মনের জোর আর নেই আমার।’

কাশ্মিরে আপেল বাগানগুলি বন দফতরের জমির ওপর তৈরি বলে দাবি সরকারের। সাত পুরুষ ধরে সেখানে আপেল চাষ করে আসছেন গুর্জর এবং বাখরওয়ালরা। শুধু এই গুর্জর এবং বাখরওয়ালরাই নন, দেশের ১০ লক্ষের বেশি তফসিলি উপজাতি এবং বনবাসীরা বন অধিকার আইন ভোগ করেন। অর্থাৎ বনাঞ্চলে বসবাসের অধিকার যেমন রয়েছে তাদের, তেমনই সেখানে বসবাসের অধিকারও রয়েছে তাদেরই। কাগজে কলমে ওই জমির উপর মালিকানাও ভোগ করেন তারা। এক সময় রাজ্য থাকলেও জম্মু-কাশ্মিরে আজও ওই আইন কার্যকর হয়নি। গত বছর উপত্যকার জন্য সংরক্ষিত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করার পর, ১৫৫টি কেন্দ্রীয় আইন আপনাআপনিই সেখানে কার্যকর হয়ে যায়। বন অধিকার আইনও সেখানে কার্যকর করা হবে বলে সেইসময় আশ্বাস দিয়েছিল জম্মু ও কাশ্মির প্রশাসন। সেই সময় উপত্যকার মুখ্যসচিব বিভিআর সুব্রহ্মণ্যমের দফতর থেকে বলা হয়, ‘২০২১-এর ১৫ জানুয়ারির মধ্যে এই সংক্রান্ত সমীক্ষা সম্পূর্ণ হলে, মার্চ মাসের মধ্যে উপত্যকায় বন অধিকার আইন কার্যকর হয়ে যাবে।’

হাজার হাজার আপেল গাছ নিধন ছাড়াও স্থানীয়দের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং উচ্ছেদ নোটিস ধরানোর পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ লুকিয়ে রয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এই মুহূর্তে উপত্যকায় গুর্জর এবং বাখরওয়াল গোষ্ঠীর প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের বাস। উপত্যকার মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ এই দুই গোষ্ঠীর মানুষ। কাশ্মিরি এবং ডোগরাদের পর তারাই সেখানকার তৃতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায়।