বাংলাদেশ কখনও ঋণের ফাঁদে পড়বে না: চীনা রাষ্ট্রদূত
- আপডেট সময় : ০৮:২৫:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুন ২০২১ ১৮৯ বার পড়া হয়েছে
২৬ জুন ২০২১, আজকের মেঘনা. কম, ডেস্ক রিপোর্টঃ
বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন যে, বাংলাদেশকে কখনও অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঋণ বা কথিত ঋণের ফাঁদে পড়ার চিন্তা করতে হবে না। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও সহযোগিতায় ‘ঋণ’ কখনও কূটনৈতিক নিয়ন্ত্রণের চাবি-কাঠি হয়ে উঠবে না বলে আশ্বস্ত করেন চীনা রাষ্ট্রদূত। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ খুব দক্ষতার সাথেই বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা করে আসছে।
চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, ‘আমি অবশ্যই বলবো যে, আপনারা খুবই দক্ষতার সাথে বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা করেছেন এবং আপনাদের কোনও অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঋণ নেই। আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বেশ সুনাম অর্জন করেছে। তাই, কথিত ঋণের ফাঁদ নিয়ে চিন্তা করবেন না।’
বৃহস্পতিবার কসমস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক: ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় (ওয়েবিনার) এক প্রশ্নের জবাবে একথা বলেন চীনা রাষ্ট্রদূত। অনুষ্ঠানটি কসমস ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজে লাইভ সম্প্রচার করা হয়।
আলোচনায় উদ্বোধনী ও সমাপনী বক্তব্য দেন কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতুল্লাহ খান এবং সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত কূটনীতিক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী।
এছাড়া সভায় আলোচক প্যানেলে ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম, সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের এম চৌধুরী, ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী গবেষক ড. জু ইওংমেং, চীনা ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সহকারী গবেষণা ফেলো ড. নিং শেংনান, সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। ওয়েবিনারে মূল আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।
আলোচনার এক পর্যায়ে চীনের অর্থায়নে সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার ঋণের ফাঁদে পড়ার বিষয়টি উঠে আসে। ঋণের ফাঁদ বর্তমান বিশ্বে কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের এক অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে। আর এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশ অঞ্চলে চীনের ব্যাপক ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে ফেলার অভিযোগ করে আসছে বিভিন্ন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংস্থা।
এরই প্রেক্ষিতে চীনা রাষ্ট্রদূত জানান, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর কোনও দেশেই ঋণের ফাঁদ তৈরির চেষ্টা করেনি চীন। তিনি দাবি করেন এমন কোনও কার্যক্রমের প্রমাণ নেই।
লি বলেন, ‘আপনাদের দেশে সুপরিকল্পিত নীতিগত কাঠামো এবং দক্ষ কর্মকর্তা ও মন্ত্রী রয়েছেন। তাই আপনাদের এই ব্যাপারে চিন্তিত হবার কিছু নেই।’
এসময় চীনা রাষ্টদূত জানান, সম্প্রতি এক নিবন্ধ পড়ে তিনি জানতে পারেন, শ্রীলঙ্কার বর্তমান মোট ঋণের মাত্র ৮ শতাংশ চীনের কাছ থেকে নেয়া। তাছাড়া, এই ৮ শতাংশ ঋণের অধিকাংশই বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে রয়েছে।
আলোচনায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, চীন বাংলাদেশের শীর্ষ বিনিয়োগকারী দেশ হিসেবে পরিণত হচ্ছে। দেশের বড়-বড় প্রকল্পগুলোতে চীনের বিনিয়োগ বাড়ছে। তার মতে, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে চীনের এমন অর্থনৈতিক কাযক্রমকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা ঋণের ফাঁদ হিসেবে উল্লেখ করছে। আর এক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাকে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
তবে এই অর্থনীতিবীদ বলেন, ‘সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে এবং দেশের মোট ঋণের বড় অংশই আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া।’
কিন্তু ২০২৪ সাল নাগাদ বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক শুধুমাত্র ঋণের কারণেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে, বলে মনে করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
ওয়েবিনারে ঋণ বিষয়ক আলোচনার জবাবে চীনা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বর্তমান চলমান সম্পর্ক ও বাংলাদেশের প্রতি চীন সরকার ও জনগণের সমর্থনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি দুই দেশের সুসম্পর্ক বাংলাদেশকে আরও লাভবান করবে বলে আশ্বস্ত করেন।
বাংলাদেশের সুতোয় বাঁধবে চীন-ভারত সম্পর্ক
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশ চীনের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় চীনা রাষ্ট্রদূত বেশ হৃদ্যতা প্রকাশ করেন। তার মতে, ভারতকে কখনও নিজেদের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেনি চীন।
তিনি বলেন, ‘চীন কখনও ভারতকে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে না। আমরা মনে করি আমাদের (চীন-ভারত) সম্পর্ক আরও উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। তাই এটা কখনও ভাববেন না যে, ভারতের প্রতি চীনের বিদ্বেষমূলক মনোভাব রয়েছে। এমন কিছুই নেই।’
ভারতের মানুষ ও এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করে লি বলেন, ‘আমরা এখনও অনেক বিষয়ে একসাথে কাজ করে যাচ্ছি। আর ঐতিহাসিক ভাবে গত দুই থেকে তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দুই অঞ্চলের মানুষের মাঝে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক আছে। যেকোনও শিক্ষিত চীনা নাগরিকের ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আলাদা একটি শ্রদ্ধার জায়গা রয়েছে, যা কখনও জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়নি।’
ভারত সম্পর্কে চীনা রাষ্ট্রদূতের আলোচনার আলোকে কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতুল্লাহ খান ২০০৪ সালে চীনের বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং ই-এর (তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) সাক্ষাৎকার নেয়ার স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ‘আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম ভারত-চীন সম্পর্কে মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? তিনি তাৎক্ষণিকভাবেই উত্তর দিয়েছিলেন- ভারত এবং চীনের মাঝে সেতু বন্ধন করতে পারে বাংলাদেশ।’
প্রযুক্তির আদান-প্রদান
প্রযুক্তির আদান-প্রদান বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত লি জানান, বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যে ব্যাপক হারে প্রযুক্তির আদান-প্রদান চলছে।
এসময় উদাহরণ হিসেবে লি আরও জানান, বেশ কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের কাছ থেকে পোশাক আমদানি করতো না চীন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের এক নম্বর রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্প খাত চীনেও জায়গা করে নিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে এখন চীনে পোশাক আমদানি করছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আপনাদের তৈরি পোশাক শিল্প খাত এখন এতটাই উন্নতি করেছে যে, বাংলাদেশের কাছ থেকে চীন গারমেন্টস পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হয় যে, দুই দেশের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রযুক্তির আদান-প্রদান ঘটছে।’
‘কোয়াড’ প্রসঙ্গে চীনা রাষ্ট্রদূতের ভাবনা
আলোচনার এক পর্যায়ে একজন আলোচক চীন বিরোধী আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ভারতের জোট- কোয়াড প্রসঙ্গ তুলে আনেন। এ বিষয়ে গত মে মাসে লি জিমিং এর মন্তব্য চীন-বাংলাদেশের মাঝে বেশ অস্বস্তির তৈরি করে।
কোয়াড প্রসঙ্গ উঠে আসায় চৈনিক এই কূটনীতিক নিজের সাফাই দেয়ার সুযোগটি লুফে নিয়ে জানান, একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে তিনি শুধু এই জোটে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো সম্ভাবনার কথা আলোচনা করতে চেয়েছিলেন।
এসময় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হবার পর এদেশের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে প্রথম যা জানতে পেরেছি, তা হলো বাংলাদেশ সকলের সাথে বন্ধুত্বে বিশ্বাস করে এবং কারো সাথে বৈরিতায় জড়াতে চায় না। তাই আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ কোনও ক্ষুদ্র চক্রান্তকারী গোষ্ঠির সাথে জড়াবে না, বিশেষ করে কোনও যুদ্ধবাজ সামরিক জোটে।’
তিস্তা প্রকল্প
চীনের অর্থায়নে তিস্তার গভীরতা বাড়ানো প্রকল্পের ব্যাপারে লি জিমিং কে প্রশ্ন করা হয়। তিনি জানান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা প্রকল্পের ব্যাপারে যে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত সাধারণ মানের।
চীনা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের প্রস্তাবনার ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আপনারা প্রথমে একটি পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা যাচাই এর প্রতিবেদন তৈরি করুন। এর পরে আমরা এই প্রকল্প মূল্যায়নের কাজ শুরু করবো। এই প্রকল্পের অর্থনৈতিক, প্রকৃতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটগুলোও আমাদের যাচাই-বাছাই করতে হবে।’