নারীদের চাকরি করার বিপক্ষে ৮৭% মানুষ
- আপডেট সময় : ০২:০৮:১৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল ২০২২ ১৬৫ বার পড়া হয়েছে
২৯ এপ্রিল ২০২২,আজকের মেঘনা ডটকম, ডেস্ক রিপোর্ট :
রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন আফরোজা বেগম। ছোটবেলা থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রবল ইচ্ছে ছিল তাঁর। সে ইচ্ছে পূরণে চাকরির জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছেন পুরোদমে। তবে বিপত্তি বাধে বিয়ের পর। শ্বশুরবাড়ির কেউই চান না আফরোজা চাকরি করুক। শেষ পর্যন্ত তাঁদের এই না চাওয়ার কাছে নিজের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন এই নারী। উচ্চশিক্ষা নিয়েও লেখাপড়া না করা সাধারণ নারীর মতোই শুধুমাত্র গৃহিণী পরিচয়েই এখন জীবন কাটাতে হচ্ছে তাঁকে।
শুধু আফরোজা নন, দেশে বিভিন্ন পেশায় যোগ দেওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন সিংহভাগ নারীকেই প্রতিনিয়ত এই ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। এমনকি কাজে যোগদানের পরেও পরিবার ও আশপাশের লোকজনের নানামুখী প্রশ্নের কারণে দমে যেতে হয়েছে অনেককে। এর প্রধান একটি কারণ হলো নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।
নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতার বিষয়টি উঠে এসেছে ইউনেসকোর এক প্রতিবেদনেও। গত বুধবার প্রকাশিত ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং-২০২২থ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৮৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক মনে করেন নারীদের বাইরে চাকরি করা ঠিক নয়।
বিশ্বের ৮৪টি দেশের নাগরিকদের ওপর ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চালানো এক জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করেছে ইউনেসকো। এতে দেখা গেছে, নারীদের বিভিন্ন পেশায় যোগ দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সবচেয়ে বৈষম্যমূলক। জরিপের অংশ নেওয়া বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক ৮৭ শতাংশ মানুষ মনে করে, নারীরা চাকরি করলে তার সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাই তাঁদের চাকরি করা ঠিক নয়। অর্থাৎ পুরুষেরা বাইরে চাকরি করে আয় করবেন, আর নারীরা বাসায় সন্তানের লালনপালন ও পরিবারের অন্য কাজগুলোয় নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবেন। তবে দেশের ১২ শতাংশ মানুষ এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পুরোপুরি উল্টো মত ডেনমার্ক, ইন্দোনেশিয়া ও জাপানের নাগরিকদের। ‘নারীর পেশায় যুক্ত হওয়া উচিত নয়থ—এই মতের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে দ্বিমত পোষণ করেছেন দেশগুলোর ৮৫ শতাংশের বেশি মানুষ।
বাংলাদেশের নারীরা পর্যাপ্ত সুযোগের অভাব ও পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এগিয়ে যেতে পারছেন না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, দেশে বস্তুগত উন্নতি হলেও এখনো মানসিক, সাংস্কৃতিক ও চিন্তাগত উন্নতি হয়নি। যত দিন পারিবারিক সব দায়িত্ব শুধুমাত্র নারীর এবং এখানে পুরুষের কোনো দায়িত্ব পালনের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে না, তত দিন এই রকমই চলতে থাকবে। এটা বৈষম্যমূলক। এ পরিস্থিতি থেকে উন্নতির জন্য সবার কাজ করা দরকার।
পেশায় যোগদান নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বৈষম্যমূলক হলেও শিক্ষায় অংশগ্রহণে ছেলেমেয়ের পার্থক্য কমে আসছে বাংলাদেশে। ইউনেসকোর প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, ২০০০ সালে নিম্ন মাধ্যমিকে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সংখ্যায় ছেলেদেরও ছাড়িয়ে গেছে মেয়েরা। স্কুল ও মাদ্রাসার মাধ্যমিকের ছাত্রীদের জন্য বৃত্তি চালুর কারণে এই অংশগ্রহণ বেড়েছে।
তবে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ ৫৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ, উচ্চমাধ্যমিকে ৫০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গিয়ে সেটা নেমে আসে ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশে।
সমাজে লিঙ্গবৈষম্যমূলক যেসব ধারণা চলে আসছে, তা সব নারীর মধ্যেই বিদ্যমান। এক্ষেত্রে মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা শেষ করা নারীর যে অবস্থা, স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করা নারীরও একই অবস্থা। বরং যাঁরা মাদ্রাসায় পড়েছেন কয়েকটি ক্ষেত্রে তাঁরা বেশি প্রগতিশীল মত দিয়েছেন। যেমন—ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ বেশি জরুরি এ ধারণা পোষণ করে ২০ শতাংশ মাদ্রাসার ছাত্রী। অথচ স্কুলে পড়ুয়া ২৬ শতাংশ ছাত্রী এই ধারণা পোষণ করে। ‘স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর শিক্ষাদীক্ষা কম হওয়া উচিতথ এমনটা মনে করে ২৫ শতাংশ মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নারী। অন্যদিক স্কুলের ছাত্রীদের মধ্যে ৩০ শতাংশ এমন চিন্তা পোষণ করে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী হতে মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের অধিক পুষ্টি প্রয়োজন এ ধারণা ২১ শতাংশ মাদ্রাসার নারী শিক্ষার্থীরা মনে করলেও স্কুলের ২৬ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী এ কথাটিতে বিশ্বাস করে।
নারীর প্রতি নারীর নিজের এবং সর্বোপরি সমাজের এত নীতিবাচক ধারণার মধ্যেও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার এবং ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক দিয়ে ছেলেদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে মেয়েরা। শুধু তাই নয়, এই পরীক্ষায় ছেলেদের চেয়েও ২৪ হাজার বেশি জিপিএ-৫ পেয়েছে মেয়েরা।