এক টাকা কামাই করলাম তিন টাকা খাইয়া : জয়নুল আবেদীন
- আপডেট সময় : ১১:০১:০২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ জুন ২০১৯ ৩৯৯ বার পড়া হয়েছে
৯ জুন ২০১৯, বিন্দুবাংলা টিভি .কম , ডেস্ক রিপোর্ট :
ভারতের লৌহপুরুষ, ৯১ বছর বয়সী দাপুটে ও প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি- বিজেপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর দলের উদ্দেশ্য বলেছিলেন,
‘দেশ আগে, দল পরে, ব্যক্তি শেষে’ ৷ এই আদর্শ সামনে রেখে বিজেপি বিপুল সাফল্যের সাথে নির্বাচন বৈতরণী পার হয়েছে। আমরা ভারতের অনুসারী। ভারতকে এতো অনুশীলনের পরেও
উক্তিটি মনে রাখতে পারি না। কারণে অকারণে
দল ও ব্যক্তিকে প্রধান্য দেয়ায় দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে পড়াসহ কুফল ভোগ করছে সাধারণ মানুষ।
গত সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রীর ভাষ্যমতে, ২০১৪-১৫ (জুলাই-মার্চ) নয় মাসের অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৬.৫১ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি আরো বৃদ্ধি করার জন্য সন্ধান শুরু হয়েছিল অর্থপ্রাপ্তির নতুন নতুন উৎস। নতুন উৎসের মধ্যে বালুমহাল অন্যতম। বালু মহাল থেকে পাওয়া অর্থের একটা অংশ যোগ হয় আমাদের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধিতে। সুধীজনের মতে, বালুমহাল থেকে প্রাপ্ত লাভের অঙ্কটা যোগ করার আগে লোকসানের অঙ্কটা একবার খতিয়ে দেখা আবশ্যাক।
জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কুমিল্লা) ১৪০০ বঙ্গাব্দে ‘নলচর মেঘনা নদী ভরাটিয়া’ ও ‘সেনের চর সাপমারা চরের গাঁও’ এই দুইটি বালুমহল সৃষ্টি করে যথাক্রমে ৪২ লক্ষ ৫০ হাজার ১০১ টাকা ও ১৩ লক্ষ ৫০ হাজার ১০১ টাকা ইজারা পেয়েছিলেন। ১৪১৫ বঙ্গাব্দে মহাল দুটির ইজারা বন্ধ রেখে ‘মেঘনা নদী বলুমহাল’ নামে ইজারা প্রদান শুরু করেন। বালুমহালটির ১৪২১ বঙ্গাব্দে ইজারা বর্ধিত হয়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ২ লক্ষ ৯৯ হাজার ৯৭৯ টাকা ৬০ পয়সা। ক্রমবর্ধমান হারে ১৪০০ থেকে ১৪২১ এই বিশ বছরের প্রাপ্ত টাকা গর করলে মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় কমবেশি ১৬ কোটি। দলীয় লোকদের কর্মসংস্থানের বিষয়টি মাথায় রেখেই কাঁচা পয়সার খনি বলে পরিচিত বালুমহাল যখন যারা ক্ষমতায় তখন তাদের নিয়ন্ত্রণে।
এর মধ্যেই মেঘনা উপজেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে টেকানগর ও নলচর পুরাণগ্রাম নামক দুটি গ্রাম এবং ৯০% হারিয়ে গেছে রামপ্রসাদের চর ও মৈশারচর নামক দু’টি গ্রাম। সোনারগাঁ উপজেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে কালির চর, খাসের চর, সোনামুখী তিনটি গ্রাম। রায়পুর ও হারিয়া দুইটি গ্রাম হারিয়ে যাওয়ার পথে।
২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৭ এক পলকে তলিয়ে গেল কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলাধীন রামপ্রসাদের চর গ্রামের শতবর্ষের প্রাচীন মসজিদ, গাছপালাসহ ২৩টি বাড়ি ও ৫০ একর ফসলি জমি। বালু উত্তোলনের কারণে কয়েক হাজার পরিবার বাস্তুহারা হয়ে খোলা আকাশের নীচে মানবেতর জীবনযাপন করছে- ক্ষতির পরিমান প্রায় ১০০কোটি টাকা বলে জানা যায়। গাছপালাসহ বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ার মর্মান্তিক ছবি সব জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হয়।
নলচর চর লাউয়াদি মৌজা, সাপমারা চরের গাও মৌজা এবং সেনের চর মৌজার তলিয়ে যাওয়া ফসলি জমির আনুমানিক পরিমান কমকরে হলেও দেড়’শ একর। সেনের চর মৌজায় প্রতি শতাংশ নাল জমির বর্তমান মূল্য ৩০ হাজার ১১ টাকা। দেড়’শ একর জমির মূল্য ৪৫ কোটি এক লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। বাড়ির মূল্য আরো বেশি। উভয় ক্ষেত্রে একত্রে কম করে হলেও শতাধিক কোটি টাকার সম্পদ ও সম্পত্তি তলিয়ে গেছে। আয় ব্যায়ের হিসেবটা সোনারগাঁয়ের বেলায়ও আরো বেশি। সরকারের নগদ রাজস্ব ১৬ কোটি টাকার উৎস বের করতে গিয়ে জনগনকে হারাতে হয়েছে কয়েক’শ কোটি টাকার সম্পদ।
রামপ্রসাদের চর এক পলকের ভাঙনে মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হলে মহামান্য হাইকোর্ট ভূমিমন্ত্রণায়সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেন। নোটিশের প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হয়। জেলাপ্রশাসক কুমিল্লা ১৪১৫ বঙ্গাব্দে মহাল দু’টির ইজারা দেয়া না দেয়ার বিষয়ে মতামতের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। (সূত্রঃ জেলা প্রশাসক কুমিল্লা মহোদয়ের কার্যালয়ের ১০-৩-২০০৮ খ্রিঃ ১৮-৫৩(অংশ)/০৮ ১০৮০ (৫)/কুম/এস এ নং স্মারক) কমিটি সরেজমিনে তদন্ত করে ইজারা বন্ধের সুপারিশ করেন। সুপারিশের পরে সুকৌশলে মহালের নাম পরিবর্তন করে “মেঘনা নদী বালু মহাল” নামে ইজারা দিতে শুরু করেন।
শুধু সম্পদ ধ্বংস নয়, সুখ-সম্প্রীতি নষ্ট হয়ে পড়াসহ
বালুমহাল এলাকায় বাড়ছে অপরাধ। র্তীরবর্তী মানুষের সাথে ইজারাদারদের বিরোধ ছাড়াও মহালের দখল ও টাকার ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাত সংঘর্ষ লেগেই রয়েছে। গত ২৮ জুন ২০১৬ পত্রিকায় প্রকাশ ‘ক্ষমতাসীন দলের দুই গ্রুপে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে মেঘনা নদীতে বালুমহলের অবৈধ দখল নিয়ে সংঘর্ষ, গোলাগুলি ও খননযন্ত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়াসহ ২০ জন আহত’। এমন কোনো বালুমহাল নেই যেখানে খুন-খারাবিসহ সংঘাত সংঘর্ষ নেই। গত দুই যুগে গ্রামের সহজ-সরল মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়েছে শোষক ও শোষিত দুই শ্রেণিতে। শোষিতরা আরো নিঃস্ব হয়ে পড়ছে আর শোষকরা আরও প্রভুত্ব, বিত্ত-বৈভবের মালিকসহ ও প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠছে। শোষণের দ্বারা অর্জিত অর্থের বেশির ভাগই ব্যয় হয় শোষিতের দমন-পীড়নে ও বিলাস-শৌখিনতায়।
এলাকাবাসী বাস্তুভিটা রক্ষার জন্য আবেদন শুরু করেছিল সেই ১৯৯৭ সাল থেকে- করা হয়েছিল মহামান্য হাইকোর্টে রীটও। রীট নং ৫৯৩/২০০৮ তারিখ ২৩.০১.২০০৮। মহামান্য হাইকোর্ট The respondent no 1-4 are directed to restrain the respondents 5-7 from digging sant from the land outside their lease area’ মর্মে আদেশ দিলেও বিস্তৃর্ণ মেঘনার তীব্র স্রোতের বুকের উপর পৃথকভাবে বালুমহালের সীমানা চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ নেই। তাই, মৎস্য আইনের মতো যেখানে নদী সেখানেই মহাল। দূর্বল আর সবলের খেলায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে, অর্থ ও পেশিশক্তির কাছে আমজনতা বড়ই অসহায়। শুধু আসহায়ই নয়, প্রতিবাদের পরিণাম চাঁদাবাজ আখ্যায়িক করে শ্রীঘরে ঢুকিয়ে দেয়া।
বছর পাঁচেক থেকে রামপ্রসাদেরচরের পাশে বালু ইত্তোলন বন্ধ থাকায় ভাঙন বন্ধ হয়ে নদীর পাড় ঢালু হতে শুরু করেছিল। মাস কয়েক আগে নতুন গড়ে ওঠা গাঁয়ের পশ্চিম দিকদিয়ে বালু উত্তোলন শুরু করতেই আবার শুরু হয় তলিয়ে যাওয়া। এর মধ্যে কয়েক একর ফসলিজমি তলিয়ে গেছে। তলিয়ে যাওয়ার জন্য প্রকৃতি নয়, দূর্লোভের বশবর্তী হয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের যোগসাজশে অপরিকল্পিত বালুমহাল সৃজন দায়ি। অপরিকল্পিত বালুমহাল সৃজনের ফলে গত দুই যুগে
তলিয়ে গেছে শতবর্ষের জনপদসহ। সরকারের বহবা কুড়াতে গিয়ে এলাকার পাঁচটি গ্রামসহ কয়েক’শ একর জমি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও হরপ্পা-মোহেনজোদারোর মতো একদিন ভুলে যাবে মানুষ। অসহায় মানুষের পক্ষে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাতি কামরুজ্জামান সালামের উদ্যোগে ৮ জুন রামপ্রসাদের চর গ্রামে এক প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। চালিভাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান জনাব আবদুল লতিফ সরকারের সভাপতিত্বে উক্ত সভার প্রধান অতিথি ছিলেন মেঘনা উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান জনাব সাইফুল্লাহ মিয়া (রতন শিকদার)। উভয় চেয়ারম্যান জনগনের পাশে থাকার দৃঢ় অঙ্গিকার ব্যক্ত করে যেকোনো মূল্যে অবৈধ ও অপরিকল্পিত বালি উত্তোলন বন্ধের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।
শুরু করেছিলাম ভারতের বিখ্যাত লালকৃষ্ণ আদবানির বক্তব্য দিয়ে শেষ করছি অখ্যাত দেওয়ান অঙ্কার উদ্ধৃতি দিয়ে। শৈশবে আমাদের অঞ্চলে সন্তান লাভসহ নানা মনস্কামনায় গাজীর গান গাওয়ানো হতো। দলনেতা অঙ্কার সাথে ঢোলক, বাঁশিবাদকসহ ৪-৫জন দোহার থাকত। অঙ্কা গায়ে আলখাল্লা ও মাথায় পাগড়ি পরে আসাদণ্ড দুলিয়ে, লম্বা পা ফেলে গাজীর গান করতো। ভালো খানা-পিনাসহ উত্তম আদোর-কদোর পেলে সংসারের খবর থাকতো না । দেওয়ান অঙ্কার বাড়ি সোনারগাঁয়ের আনন্দবাজার। গান করে ঘরে ঘরে আনন্দ দিলেও তাঁর নিজের ঘরে আনন্দ ছিল না। অভাব-অনটনের সংসারে অশান্তি লেগেই থাকতো। তাই জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে জীবনের শেষ অঙ্কটা মিলাতে পারেননি অঙ্কা। জীবনের অঙ্ক মিলাতে ব্যর্থ হয়ে সখেদে বলে গেছেন।
………..কি করলাম গাজীর গীত গাইয়া,
এক টাকা কামাই করলাম তিন টাকা খাইয়া।
………………..জয়নুল আবেদীন । জয়নুল আবেদীন এর ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া ।